মানুষ তুমি ক্ষণিক থামো : এডভোকেট ধৃতিমান আইচ
এমএসকে নিউজ :: মানুষ তুমি থামো। বন্ধ রেখো তোমার চাকা। বন্ধ রেখো তোমার কর্মস্থল। অতীতে কেউ কি পেরেছে তোমাকে থামাতে? গৃহ অন্তরীণ রাখতে দীর্ঘ সময়? পারেনি তোমার ধ্বংস লীলার আয়োজন থামাতে,পারেনি তোমার ব্যাপক চাহিদার লাগাম টানতে, পারেনি ধর্মের নামে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে হিংসা হানাহানির যবনিকা টানতে, পারেনি রাজনীতির নামে হত্যা, রক্তপাত কমাতে, পারেনি রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধের ইতি টানতে, পারেনি পারমানবিক অস্ত্র উৎপাদন ও পরীক্ষা বন্ধ করতে, পারেনি সবল রাষ্ট্র দ্বারা দূর্বল রাষ্ট্রের ওপর অত্যাচারের স্ট্রীম রোলার বন্ধ করতে, পারেনি তোমার দ্বারা সৃষ্ট প্রাকৃতিক বির্পযয় রোধ করতে। এই সবের পিছনে মানুষ, তুমি দায়ী। অস্বীকার করার কোন জোঁ নেই। তাই তোমার রূঢ় অগ্রযাত্রা থামাতে প্রকৃতির এই আয়োজন ‘করোনা’। যদি বুঝো, তুমি থামো, সাবধান হও। নতুবা করোনার থাবায় তুমি নিঃশেষ হও। যাদের জন্য তোমার রূঢ় অগ্রযাত্রা সে আপনজনেরা শরীক হবেনা তোমার অন্তিম যাত্রায়। কি নির্মম পরিহাস!
আমি। আমিও একজন মানুষ। আমার চাওয়া পাওয়া বা চাহিদা প্রতিনিয়ত ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হওয়ার কারণে ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি বিভিন্নভাবে। ওজন স্তর হ্রাস পাচ্ছে। আহার্য ফলমূলে বিষাক্ত ক্যামিক্যাল,ফরমালিন মিশানো হচ্ছে। আমরা নিত্য ব্যবহার্য ময়লা আর্বজনা যত্রতত্র ফেলছি। আমার ব্যবহৃত গাড়ির কালো ধোঁয়ায় বিষাক্ত করছি চারদিক। শিল্প কারখানার বিষাক্ত ক্যামিক্যাল নদীর পানিতে ফেলছি।প্রতিনিয়ত ঘুষ দূর্নীতি করে হয়রানি করে মানুষকে কষ্ট দিচ্ছি।জেনে শুনে বিভিন্ন অপরাধজনক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছি।
রাষ্ট্র। আপনিও মানুষ। কারণ আপনি মানুষ দ্বারা পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। আপনিও চান প্রতিভু হতে।সকল রাষ্ট্রের ওপর কর্তৃত্ব করতে,শাসন করতে,হুকুম করতে। আপনি বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হতে চান। আর এটা হতে চান বলে বিভিন্ন অপকর্ম করতে হয়।অপকৌশল,অপরাজনীতির আশ্রয় নিতে হয়।দেশে দেশে বিভিন্ন অজুহাতে হানাহানি,রক্তপাত,হত্যার স্বাদ নিতে হয়। সবকিছুর পিছনে মানুষ তুমি জড়িত। তোমার হাত প্রসারিত চাহিদা আকাঙ্খা ব্যাপক হতে ব্যাপকতর হওয়ার পিছনে।মানুষ তুমি যে ভালো না সেটা বলবো না।ভালো আছে বলেই খারাপ বা কুৎসিত দিকটা অবলোকন করছি।
লালনের সে কথা মনে পড়ে, ” শুনি মরিলে পাব বেহেস্তখানা, তা শুনে তো মন মানেনা, বাকীর লোভে নগদ পাওনা কে ছাড়ে এই ভূবনে।” মরার পর যে বেহেস্তখানা পাওয়া সেটাকে লালন বাকী বলছে আর বর্তমান পাওয়াটাকে নগদ বলছে। আসলে কি তাই? আবার কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তাঁর এক লেখায় লেখেন এভাবে,” ইহকাল ভূলে যারা পরকালে মত্ত হয়ে আছে চলে যাক সব পরপারে বেহেস্তখানা তাদের, আমরা থাকবো এই পৃথিবীর মাটি জলে নীলে,দ্বন্ধময় সভ্যতার গতিশীল স্রোতের ধারায় আগামীর স্বপ্ন বুনে যাবো সমতার বীজ।”
স্রস্টার সৃষ্টির মধ্যে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব।বলা হয় আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষকে সবকিছু দিয়ে সৃষ্টি করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কান দিয়ে শুনার,চোখ দিয়ে দেখার,হাত দিয়ে স্পর্শ করার,নাক দিয়ে ঘ্রাণ নেয়ার,মাথা দিয়ে ভাল মন্দ অনুধাবন করার,মুখ দিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করার অধিকার দিয়েছে। এত সম্মান দিয়ে সম্মানিত করা জীব মানব স্রষ্টার আদেশ,অনুশাসনের প্রতি কি অনুরক্ত আছি? অর্থাৎ আমার পঞ্চইন্দ্রিয়কে কি সংযত অবস্থায় রাখতে পেরেছি?
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বিদায় হজ্বের ভাষণে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে বলেছেন,” তোমাদের এই পবিত্র শহরে এই পবিত্র মাসে আজকের দিনটি যেমন পবিত্র ও মর্যাদাবান, তেমনি তোমাদের পরস্পরের রক্ত,তোমাদের পরস্পরের ধনসম্পদ এবং পরস্পরের মান সম্মান ও তেমনই পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ। ( বুখারী শরীফ ১ম খন্ড পৃষ্ঠা ২৩৪)
অন্যদিকে হিন্দু ধর্মের মনুসংহিতা মতে ধর্ম হচ্ছে কতকগুলো গুণের সমষ্টি। উল্লেখ আছে এভাবে,
ধৃতিঃক্ষা দমোহস্তেয়ং শৌচমিন্দ্রয়নিগ্রহঃ ধীবিদ্যা সত্যমক্রোধো দশকং ধর্মলক্ষণম্। (মনুসংহিতা ৬/৯২)
অর্থাৎ সহিষ্ণুতা ( ধৈর্য) , ক্ষমা,আত্মসংযম, চুরি না করা, শুচিতা, ইন্দ্রিয়সংযম, শুদ্ধবুদ্ধি( প্রজ্ঞা), বিদ্যা,সত্য এবং অক্রোধ (ক্রোধহীনতা) এই দশটি হচ্ছে ধর্মের লক্ষণ।এই দশটি গুণ যথাযথভাবে অনুশীলন করতে পারলে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে।
আমরা প্রত্যকে যদি প্রত্যকের ধর্মীয় অনুশাসন ও বিধিবিধান যথাযথভাবে পালন ও অনুসরণ করি তাহলে আমরা প্রত্যকেই সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবো। এখন যে ক্রান্তিকাল পাড়ি দিচ্ছি এই সময়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর সে কবিতাটির পঙক্তিগুলো মনে পড়ে-
” হিন্দু না ওরা মুসলিম এই জিজ্ঞাসে কোনজন হে,কান্ডারী বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’ র।”
মহামারীর এই সময়ে অন্তত আমরা ধর্মীয় অনুশাসন ও বিধিবিধান যথাযথভাবে অনুসরণ ও প্রত্যেকের ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করি, নিজেদের মধ্যে প্রকৃত মনুষ্যত্ব জাগ্রত করতে পারি তাহলে এই করোনার তান্ডব থামাতে পারবে না মানুষের অগ্রযাত্রা। যতোই বলো থামো মানুষ, তা হবে ক্ষণিকের। পুরোদমে আবারো এগিয়ে যাবে মানুষ। বর্তমানে মানুষের রক্ষণাত্বক ভূমিকা মানুষের দূর্বলতা নয় করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের একটা কৌশল মাত্র। আসুন এই কৌশল রপ্ত করি,ঘরে থাকি। নিজে বাঁচি, পরিবারকে বাঁচায়, রাষ্ট্রকে বাঁচায়।
লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠক।