0 5
করোনাকালে মানবেতর জীবনযাপন করছেন নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীরা
অধ্যক্ষ এম সোলাইমান কাসেমী
করোনার মধ্যেও দীর্ঘদিন থেকে অফিস, গার্মেন্ট, কলকারখানাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান এক ধরনের স্বাভাবিকতার ভেতর দিয়ে চলছে। শুধু বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে শিক্ষাসূচি। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিতে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অর্থনীতিতে ক্ষতি হলে বেশি কাজ করে বা নতুন বিনিয়োগ করে তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু শিক্ষায় ক্ষতি হলে তা সহজেই পোষানো সম্ভব নয়। এমনকি একটি জাতিকে সারা জীবন এই ক্ষতি বয়ে বেড়াতে হয়। ফলে করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শিক্ষায়।
শিক্ষকতা পৃথিবীর সবচেয়ে মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী একটি পেশা। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই বাস্তব এবং গবেষণায় প্রমাণিত। করোনাকালে শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটেছে, যা আমাদের শিক্ষকদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। শিক্ষক যদি ঠিক না থাকেন, তবে শিক্ষাব্যবস্থাও ঠিক থাকবে না।১৮ মার্চ ২০২০ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কবে খুলবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই অনিশ্চয়তায় প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থীর পড়ালেখা একদিকে বন্ধ হয়ে গেছে, অন্যদিকে শিক্ষকদের জীবনে নেমে এসেছে ভয়াবহ অমানিশা। ফলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা পড়েছে হুমকির মুখে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন প্রতিবেদন ও সামাজিক মাধ্যমের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী ছাড়া আর কোনো শিক্ষক-কর্মচারী ভালো নেই।
কিন্ডারগার্টেন স্কুল, প্রাইভেট স্কুল, মাদ্রাসা, জাতীয়করণ না হওয়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা করোনাকালীন দুর্যোগে দুঃসহ জীবন অতিবাহিত করছেন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের বেতন-ভাতা দিয়ে চলে। করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন নিতে পারছেন না প্রতিষ্ঠানগুলো। অধিকাংশ অভিভাবকেরই এখন বেতন দেয়ার সামর্থ্য নেই। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা বিগত অনেক মাস ধরে কোনো বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। এমনিতেই তারা স্বল্প বেতন পেতেন, সেই বেতন বন্ধ হওয়ায় এবং বাড়তি কাজ হিসেবে টিউশন ও কোচিং করিয়ে যে অর্থ আয় করতেন সেসব বন্ধ হওয়ায় তারা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বেঁচে থাকার তাগিদে বাধ্য হয়ে অনেকেই পেশা পরিবর্তন করছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিক্ষকদের দুর্দশার চিত্র উঠে আসছে। জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষক সমাজের অনেকে পেটের দায়ে কৃষিকাজ করছেন, ভ্যান চালাচ্ছেন, ইজিবাইক চালাচ্ছেন, ফল ও সবজি বিক্রি করছেন, ভেটেরিনারি মেডিসিন বিক্রি করছেন, রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন। শহর ছেড়ে অনেকে চলে গেছেন গ্রামে। কী করে সংসার চালাবেন এই চিন্তায় দিন দিন মুষড়ে পড়ছেন বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা। অর্থবিত্ত না থাকলেও শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা আছে। এ কারণে লজ্জায় তারা ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতে বা মানুষের কাছে হাত পাততে পারছেন না।
দেশে ৬০ হাজারের বেশি কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে। এই স্কুলগুলোয় ৬ লাখের বেশি শিক্ষক কর্মরত। আছে কয়েক লাখ কর্মচারীও। কিন্তু করোনার কারণে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা পড়েছেন বিপাকে।দেশের অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেনই চলে ভাড়া বাসায়। কিন্তু করোনার কারণে বাসা ভাড়া না দিতে পেরে ইতোমধ্যে অনেক স্কুল বিক্রি হয়ে গেছে। ফলে এসব স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীরা চাকরি হারাচ্ছেন। শিক্ষকদের এ দুর্দশা লাঘব ছাড়া গুণগত শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না। তাই শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে সর্বাগ্রে এই শিক্ষকদের দুর্দশা লাঘব করতে হবে। সরকারের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার আগ পর্যন্ত জাতি গঠনের কারিগরদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। প্রয়োজনে মাসিক বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বিনা সুদে ঋণ হিসেবে দেয়া যেতে পারে। গার্মেন্টসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে নানা ধরনের প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ ক্ষেত্র শিক্ষা এর বাইরে থেকে গেছে। শুধু করোনাকালীন প্রণোদনাই নয়, শিক্ষকদের উন্নয়নে নিতে হবে দুর্দশা লাঘবের টেকসই উদ্যোগ। কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোয় শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি নির্দিষ্ট নীতিমালার অধীনে সরকারি তত্ত্বাবধান ও অর্থ সহায়তার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
করোনা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে, অনেক দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতাগুলোও আমরা বুঝতে পেরেছি। এ শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে আমাদের ঢেলে সাজাতে হবে যেন যত দুর্যোগই আসুক, আমাদের শিক্ষক সমাজকে আর দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হবে না। তাহলেই আমরা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যেমে টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।
লেখক: অধ্যক্ষ এম সোলাইমান কাসেমী, শিক্ষা চিন্তক ও গবেষক।