অটিজম ও দেবশিশু : অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

0 4

এমএসকে নিউজ ডেস্ক :: অটিজম এক বিশেষ ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধকতা, যার শুরু শৈশবে, কিন্তু স্থায়িত্ব প্রায় সারাজীবনের। সাধারণভাবে মানসিক প্রতিবন্ধী বলতে মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়া বা নিম্নমানের বুদ্ধিসম্পন্ন শিশুদেরই বোঝানো হয়। কিন্তু অটিস্টিক শিশুদের কিছুসংখ্যকের বুদ্ধাঙ্ক (I.Q) স্বাভাবিক মানুষের চেয়েও বেশি হয়। পৃথিবীতে অনেক বড়ো বড়ো মনীষী বা প্রখ্যাত ব্যক্তি অটিস্টিক ছিলেন। যেমন ইদানীংকালে ADHD-এর অ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদদের আধিক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। অটিজম কোনো রোগ-ব্যাধি নয়। শুরুতে, অর্থাত্ ১৯৪৩ সালে লিও ক্যানার অটিজমকে একটি সামাজিক ও আবেগজনিত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। লিও ক্যানারের মতে, এ ধরনের শিশুগুলো কেউ কেউ খুবই বুদ্ধিমান, কিন্তু তারা নিজেকে নিজেদের মধ্যেই লুকিয়ে রাখে। এমনকি ন্যূনতম আবেগের কারণে সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়।

অটিস্টিক শিশুর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, সবার মাঝে থেকেও নিজের একাকিত্ব। অস্বাভাবিক খেলা, যেমন জড়বস্তু নিয়ে তাত্পর্যহীন খেলা, যে কোনো বস্তু ঘোরানো বা পাক খাওয়ানো, যেমন খেলনা গাড়ি হাতে পেলে সেটি উলটে চাকাটা হাত দিয়ে ঘোরানো ইত্যাদি, অন্য ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি ঔদাসীন্য, অদ্ভুত গতিবিধি ও মুদ্রাদোষ, যেমন অপ্রয়োজনীয় হাঁটা, অপ্রয়োজনীয় ও অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে মুখে শব্দ করা ইত্যাদি। আরো আছে। অস্বাভাবিক শিখন পদ্ধতি আয়ত্ত করতে না পারা, অস্বাভাবিক সামাজিক আচরণ। বাক্হীনতা বা বাক্স্বল্পতা, স্থান, কাল বা ব্যবহারের পরিবর্তনে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া, দৃষ্টি বিনিময়ের অভাব—মানুষের সঙ্গে অথবা বস্তুর সঙ্গে, অর্থহীনভাবে শব্দের প্রতিধ্বনি করা, বিশৃঙ্খল আচরণ। কখনো কখনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা—যেমন গান, অঙ্ক ইত্যাদি। নতুন নতুন শব্দ শিখলেও তাদের ধারণক্ষমতা সীমাবদ্ধ। আজ যা শেখাবেন কাল তা ভুলে যেতে পারে। যেমন পিসি বাড়িতে এলো, সবাই বলাবলি করল পিসি এসেছে। তখন দেখা যাবে সে সবকিছুর সঙ্গেই পিসি শব্দ জুড়ে দেবে, যেমন : মা পিসি, বাবা পিসি, টিকটিকি পিসি, পাখা পিসি, টেবিল পিসি ইত্যাদি। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, কিছুদিন পর সে আবার সব ভুলে যাবে। বুদ্ধ্যাঙ্ক (I.Q) স্বাভাবিক বা উচ্চমানের হতেও পারে। সব বৈশিষ্ট্যই সব অটিস্টিক শিশুর মধ্যে সমানভাবে না-ও থাকতে পারে। বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অটিস্টিক শিশুর প্রকারভেদ করা হয়।

বাংলাদেশে অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্ট ডিসঅ্যাবিলিটি নিয়ে যেটুকু কাজ হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে ও নির্দেশনায়। ২০১০ সালে CNAC (Centre for Neurodevelopment and autism in Children) কর্মসূচি হিসেবে সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয় প্রথমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রশাসনের অক্লান্ত পরিশ্রমে, যার উদ্বোধন করেন শিশু প্রেমিক, শিশু বশীকরণের অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারিণী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

২০১১ সালের ২৫ জুলাইয়ের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন, ১০০০ ডেলিগেট নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার রূপসী বাংলা হোটেলে, যার উপদেষ্টা এবং মূল চালিকাশক্তি ছিলেন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক প্যানেলের অন্যতম উপদেষ্টা ব্যক্তিত্ব সায়েমা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল। ঐ সম্মেলনের মূল আকর্ষণ ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মিসেস সোনিয়া গান্ধী, শ্রীলঙ্কার ফার্স্টলডি মিসেস রাজা পক্ষে এবং মালদ্বীপের ভাইস প্রেসিডেন্ট পত্নী মিসেস এলহাম। তাছাড়া বিশ্বের স্বনামধন্য স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যার গবেষক, শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞগণ। এনডিডি, অর্থাত্ Neuro developmental disability, বাংলায় স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যার পরিসংখ্যান দেখলে কিন্তু আঁতকে উঠতে হয়। ২০১৬ সালে এর অনুপাত ১:৬৮। অর্থাত্, প্রতি ৬৮ জনে ১ জন। সর্বোচ্চ সংখ্যা হলো কোরিয়াতে, অর্থাত্ ১ :৩৮।

তাই সরকারের সুশাসনের পাশাপাশি, বিত্তবানদের বিত্ত যদি সত্যিকার Charity বা দাতব্য হিসেবে ব্যয়িত হয়, তাহলেই হয়তোবা ঐ সব দেবশিশুর (Gifted baby) ভবিষ্যত্ প্রজ্বলিত হবে। এসব শিশুর জন্য দরকার সহানুভূতি ও পরিচর্যা, অর্থাত্ সব সময়ই হাসিখুশিভাবে তাদের লালন করা। ‘Smiling is a language that everybody understand, it cost nothing but creates much, it happens suddenly but its memory may last for ever.’ আমরা কি পারি না, বর্তমান যুগের আইনেস্টাইন জ্যাকব বার্নেটের মতো একজন পদার্থবিজ্ঞানী তৈরির প্রচেষ্টা নিতে? সুধী পাঠক, দেখুন জ্যাকব কে। আমার কথা, ‘অটিজম নিয়ে আমাদের শুরু সবার শেষে– প্রখ্যাত শিশু মনস্তত্ত্ববিদ মিসেস সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুলের হাত ধরে এবং নেতৃত্বে। ২৫ জুলাই ২০১১ থেকে অদ্যাবধি আমাদের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। এই শিশুরা আমাদের স্বপ্ন ও সন্তান। বর্তমান ও ভবিষ্যত্। হয়তো তাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে একজন আইনস্টাইন। তারা কোথায় যেন একটু খাটো, অপারগ। দেহ-মন ও মস্তিষ্কে তেমন শক্তপোক্ত নয়। বহুজনের ভালোবাসার কল্যাণ স্পর্শ একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু তাদের যদি না চিনি, না জানি, তাহলে কী করে ভালোবাসব, পরিচর্যার হাত বাড়িয়ে দেব? এখানেই আরো বেশি জরুরি, ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে তাকে ও তার পরিবারকে আরো কাছে টেনে আনার। তাহলেই সবাই বিনে সুতার মালায় গেঁথে থাকব।’

UNCRPD (United Nations Convention on Rights for Person with Disabilities)-এর চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে আমাদের উচিত যথাযথ ও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জাতিসংঘ নির্দেশিত শর্তগুলি পালন করা। শুধু তখনই হবে তাদের প্রতি প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন। এখানে গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ ২০১৩ সালে শুরু এবং ২০১৪ সালের মধ্যে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন, ২০১৩ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন ও কল্যাণে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের বিধিমালা, ২০১৪ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা বিধিমালা, ২০১৪ প্রণয়ন করা হয়েছে। What’s more, world autism awareness day goes one step further to celebrate the unique talents of those with Autism, while putting a focus on the warm embrace and welcome that these skills deserve through community events around the globe.

‘জয় হোক মানবতার’

লেখক : অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

ভাইস চ্যান্সেলর (সাবেক),

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

Leave A Reply

Your email address will not be published.